বাংলাদেশের কুটির শিল্প গৌবরময় ঐতিহ্যবাহী একটি শিল্প। এ শিল্প বাংলার আবহমান কাল থেকে চলে আসছে। গৌবরময় সংস্কৃতির প্রতিভাস ফুটে ওঠে, যার নির্মাতা পল্লী অঞ্চলের মানুষ। নিজেদের জীবিকা অর্জন এবং নিজস্ব ব্যবহারের জন্য তারা এ সকল পণ্য উৎপাদন করে থাকে। গ্রাম বাংলার প্রকৃতি, মানুষ, পশুপাখি, লতাপাতা, গাছপালা, নদ-নদী ও আকাশ তাদের কুটির শিল্পের চিত্রকর্মে দেখা যায়। কুটির শিল্পের নানা ধরনের সুন্দর সুন্দর নাম রয়েছে। যেমন- হস্তশিল্প, কারুশিল্প, সৌখিন শিল্পকর্ম, গ্রামীণ শিল্পও। বর্তমানে গ্রাম থেকে ছাড়িয়ে শহর এলাকায়ও কুটির শিল্পের প্রসার ঘটছে।
কুটির শিল্প গৌবরময় ঐতিহ্যবাহী একটি শিল্প |
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)-এর মতে- ‘যে শিল্প কারখানা একই পরিবারের সদস্য দ্বারা পূর্ণ বা আংশিকভাবে পরিচালিত এবং পারিবারিক কারিগর খন্ডকালীন বা পূর্ণ সময়ের জন্য উৎপাদন কার্যে নিয়োজিত থাকেন এবং যে শিল্পে শক্তিচালিত যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হলে ১০ জনের বেশি এবং শক্তি চালিত যন্ত্র ব্যবহৃত না হলে ২০ জনের বেশি কারিগর উৎপাদন কার্যে নিয়োজিত থাকে না তাই কুটির শিল্প’। শিল্পনীতি ২০১০-এ বলা হয়েছে, ‘যেসব প্রতিষ্ঠানে জমি এবং কারখানা ব্যতিরেকে স্থায়ী সম্পদের মূল্য প্রতিস্থাপন ব্যয়সহ ৫ লক্ষ টাকার নীচে এবং পারিবারিক সদস্য সমন্বয়ে সর্বোচ্চ জনবল ১০-এর অধিক নয় এরূপ শিল্প প্রতিষ্ঠান হচ্ছে কুটির শিল্প।’
বাংলার কুটির শিল্পের ইতিহাস খুবই প্রাচীন। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা লম্বা সময় বাংলায় ভ্রমণ করেন, তার ভ্রমণ বিবরণী থেকে জানা যায়, তৎকালে অত্র বাংলায় পৃথিবীখ্যাত মসলিন উৎপাদিত হতো। প্রাক-ব্রিটিশ বাংলায় সুতিবস্ত্র উৎপাদন বিশুদ্ধ কারুশিল্পরীতি বা গৃহে উৎপাদন ব্যবস্থা দ্বারা সুসংগঠিত ছিল। মুগল সম্রাটদের আমলে কুটির শিল্প সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। ওলন্দাজ, ইংরেজ ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিসহ অন্যান্য বণিকরা প্রথমদিকে বাংলার কুটির শিল্পে উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রপ্তানির জন্য তাঁত ও অন্যান্য হস্তশিল্পকে অর্থের জোগান দিত। পরবর্তীকালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীগণ স্থানীয় তাঁতবস্ত্র, বুননশিল্প ও অন্যান্য কুটির শিল্পে নির্যাতন চালায়। যেখানে ১৮১৫ সালে এদেশ থেকে ১ কোটি ৩০ লক্ষ টাকার কাপড় রপ্তানি হয়েছে সেখানে ১৮৩২ সালে কমে গিয়ে দাঁড়ায় মাত্র ১০ লক্ষ টাকায়, পরের বছর তা শূণ্যের কোটায় নেমে আসে। উল্টো ১৮৩২ সালে ইংল্যান্ড থেকে ৪০ লক্ষ টাকার বিদেশি কাপড় আমদানি করা হয়। এরপর থেকে কুটির শিল্পের অগ্রগতি তেমন পরিলক্ষিত হয়নি। দেশ বিভাগের ফলে গৌরবময় কুটির শিল্পজাত পণ্যের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। এ কুটির শিল্পের ব্যবসাটি মূলত হিন্দু মহাজনদের হাতে ছিল। যখন দেশ ভাগ হয় তখন অধিকাংশ দেশ ত্যাগ করে। ফলে কুটির শিল্পজাত ব্যবসায় বড় শূণ্যতার সৃষ্টি হয়। 1947 সালে দেশ ভাগ হওয়ার পর পাকিস্তানি আমলের গোড়ার দিকে কুটির শিল্পে বৃহৎ বিনিয়োগ ছিল না বললেই চলে। এর মধ্যে প্রায় ৬৫% ছিল পূর্ব পাকিস্তানে। প্রায় ১ হাজার ৬শত পেশাজীবী কারিগর নিয়োজিত ছিল। তাঁত শিল্পে নিয়োজিত ছিল প্রায় ৪ লক্ষ লোক। সারা বাংলায় ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত এ কুটির শিল্প বস্ত্রের চাহিদা মিটিয়েছে। কুটির শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষুদ্র ও নানা মুখি উদ্যোগ গ্রহণ করে। সরকারি আইনের মাধ্যমে ১৯৫৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা (ইপসিক) প্রতিষ্ঠা করা হয়। স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের কুটির শিল্পসহ সমগ্র শিল্পখাত ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন লাভের পর সরকার কুটির শিল্পকে পুনর্গঠন এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে। পূর্ব পাকিস্তান ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থাকে পুনর্গঠন করে নতুন নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। এই প্রতিষ্ঠানটি ঐতিহ্যবাহী নৈপূণ্যভিত্তিক প্রযুক্তির ব্যবহার পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ, সমীক্ষা প্রণয়ন, বিপণন ব্যবস্থা এবং বিভিন্ন ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে নিয়োজিত কারুশিল্পীদের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়। ১৯৮১ সালে বিসিক-এর একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশে ১৬০ ধরনের দ্রব্য সামগ্রী উৎপাদনে ৩ কোটি ২২ লক্ষ কুটির শিল্পের কারখানা বিদ্যমান রয়েছে।
২০০৫ সালে বিভিন্ন জরিপে দেখা যায়, দেশে প্রায় ৭ লক্ষ শিল্প ইউনিট রয়েছে যার মধ্যে ৬০০০ বৃহৎ, ৫০০০ মাঝারি, ৭৬,০০০ ক্ষুদ্র এবং কুটির শিল্প প্রায় ৬ লক্ষ ২০ হাজার রয়েছে। ১৯৯৯-২০০০ সালে বিসিকে মোট ৪,০৮৫টি শিল্প প্রতিষ্ঠান নিবন্ধীকৃত হয়। এর মধ্যে ৩,২৪০টি কুটির শিল্প। এ সময়ে কুটির শিল্পে মোট বিনিয়োগ ছিল ৫০ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা এবং এইসব শিল্প প্রতিষ্ঠানে ৪০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়।
আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী কুটির শিল্পকে আট শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে। এগুলো হলো ক) খাদ্য, পানীয়, তামাক প্রক্রিয়াকরণ শিল্প: দুগ্ধজাত, ফল প্রক্রিয়া ও টিনজাতকরণ, মৎস্য প্রক্রিয়া ও টিনজাতকরণ, আদা শুষ্ককরণ, ডালমিল, আটামিল, ময়দামিল, অন্যান্য শস্য কারখানা, তেল কল, চাল কল, মসলা চূর্ণকরণ, বেকারি, গুড় তৈরি, পশু খাদ্য, মুরগির খাদ্য, বরফ, খয়ের, লবণ তৈরি, মিষ্টান্ন, মধু প্রক্রিয়াকরণ, পানীয়, বিড়ি, হুক্কা, তামাক, জর্দা, মৌমাছি পালন, মৎস্য চাষ, ঘানির তৈল, হাঁস, মুরগি পালন, চিড়া ও মুড়ি তৈরি। খ) বস্ত্র ও চামড়া শিল্প: সুতা কাটা, রেশমজাত দ্রব্য, হস্তচালিত তাঁত, বস্ত্র মুদ্রণ, জামদানি, সুচিকর্ম, হোসিয়ারি, মোজা তৈরি, উলজাত দ্রব্য, নারিকেলের ছোবড়াজাত দ্রব্য, পাটের সুতা, ছিকা, মাছ ধরার জাল, পোশাক শিল্প, চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ, চামড়াজাত দ্রব্য, বাটিক, সতরঞ্জি, কার্পেট। গ) কাঠজাত শিল্প: নৌকা তৈরি, খেলনা, কাঠের আসবাবপত্র, বেত ও বাঁশজাত দ্রব্যাদি ও আসবাবপত্র, খেলাধুলার সামান, হুক্কা তৈরি, বাদ্যযন্ত্র, মাদুর শিল্প, কাঠ খোদাই, কাঠের কৃষি সরঞ্জামাদি, ঘর সাজানোর দ্রব্যাদি এবং কাঠের উপজাত। ঘ) মুদ্রণ ও মোড়কসহ কাগজ শিল্প: পুরনো কাগজজাত দ্রব্য, মুদ্রণালয়, বই বাঁধাই, কাগজের হস্তশিল্প, কাগজের ব্যাগ, কাগজের ফুল ইত্যাদি। ঙ) রাসায়নিক, পেট্রোলিয়াম ও রসায়নজাত শিল্প: এ্যালোপ্যাথিক, ইউনানী আয়ুর্বেদীয় ঔষধ, ছাপা ও রঞ্জন শিল্প, রঙ এবং বাণিজ্য, আগরবাতি, প্রসাধনী সামগ্রী, সাবান তৈরি, বুট পলিশ, মোম তৈরি, চিরনি ও বোতাম, মৃৎ শিল্প, কাঁচ শিল্প, চুনজাত দ্রব্যাদি, শিল পাটা, চক তৈরি, শ্লেট ও পেন্সিল, প্লাস্টিকের খেলনা ও ফুল ব্যাগ ইত্যাদি। চ) অধাতব খনিজ শিল্প: চুনাপাথর ও শামুকজাত চুন, রঙীন চক, খড়ি মাটি, শঙখজাত দ্রব্য, বোতাম ও চুড়ি ইত্যাদি। ছ) মেশিনারি ও যন্ত্রপাতিসহ ধাতব শিল্প: লৌহজাত আসবাবপত্র, ইলেট্রোপ্লেটিং, তারের জাল, ধাতব পাত ও মুদ্রণ, তারকাটা, কাঁসা ও পিতল, স্টীল ট্যাংক, মেশিনারি সামগ্রী, কৃষি যন্ত্রপাতি, চুলের ক্লিপ, বৈদ্যুতিক সামগ্রী, জুয়েলারী, হালকা ইঞ্জিনিয়ারিং, কামার শিল্প প্রভৃতি। জ) হস্ত শিল্পসহ অন্যান্য শিল্প।
মৃৎ শিল্পঃ বাংলাদেশের অন্যতম মৃৎ শিল্পের মধ্যে মাটির তৈরি বিভিন্ন পুতুল, দেবদেবীর মুর্তি, গার্হস্থ্য দ্রব্যাদি, মাটির ভাস্কর্য, টালি, শখের হাঁড়ি, মনশাঘট ও ফুলদানি ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। গ্রাম বাংলার উল্লেখযোগ্য মৃৎ শিল্প পল্লী কুমিল্লার বিজয়পুর, পটুয়খালীর মদনপুরা, ফেনীর চম্পকনগর, শরিয়তপুরের কার্ত্তিকপুর এবং ঢাকার রায়ের বাজারে অবস্থিত।
বস্ত্র শিল্পঃ আমাদের দেশীয় বস্ত্র শিল্পের মধ্যে রয়েছে শাড়, লুঙ্গি, ধুতি, গামছা, মশারি, তোয়ালে, ইত্যাদি। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী বস্ত্রের তালিকায় রয়েছে- উপজাতীয় বস্ত্র, মসলিন, জামদানী, মলমল টরোয়ো শাড়, পাবনার শাড়, টাঙ্গাইলের শাড়ি, কাতান, রেশমবস্ত্র, খদ্দর বস্ত্র ইত্যাদি।
পাটজাত শিল্পঃ পাট দিয়ে নানা ধরনের মোটিভের সিকা, টেবিলম্যাট, শতরঞ্জি, কার্পেট, সৌখিন হ্যান্ডব্যাগ, থলে ইত্যাদি তৈরি করা হয়। এসব পণ্য পাটজাত পণ্য হিসেবে পরিচিত।
বাঁশ-বেত শিল্পঃ বাঁশ ও বেত শিল্পের মাধ্যে রয়েছে সাধারণত বাঁশ বেত সামগ্রী, বেড়া, চাটাই, মাছধরার ফাঁদ, হাতপাখা, মোড়া, সোফাসেট, টেবিলম্যাট, ওয়ালম্যাট, ট্রে, ফুলদানি, ছাইদানি ইত্যাদি তৈরি করা হয়। বাঁশ-বেত শিল্প বিসিকের সমীক্ষা (১৯৮৫) অনুযায়ী মোট শিল্প ইউনিট সংখ্যা ৪২ হাজার, নিয়োজিত শ্রমিক সংখ্যা ১ লক্ষ ২২ হাজার জন। মোট ব্যবহূত কাঁচামালের বাৎসরিক মূল্য ২২ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা।
শীতলপাটিঃ বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী একটি কারু শিল্প বা কুটির শিল্প শীতলপাটি। শীতলপাটি এক ধরনের চাটাই যা মোরতা নামক গাছেল বাকল তৈরি। পশুপাখি, লতাপাতা এবং পারিপার্শ্বিকতার ডিজাইন ও মোটিভে শীতলপাটি তৈরি করা হয় যেখানে আবহমান গ্রাম বাংলার প্রকৃতি, রূপ এবং সৌন্দর্যকে কারুকাজের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়।
গহনা শিল্পঃ বাংলার নারীদের অন্যতম পছন্দ, হাতে তৈরি নানা ধরনের গহনা সামগ্রী। এসবের মধ্যে আছে কানে কানপাশা, সিঁথিতে ঝাপা, ঝুমকা, নবরত্ন ও চক্রবালি, হীরাম মুল কুড়ি, নাকে বেশর নথ, ফুরফুরি, গলায় পুষ্পহার, সীতাহার, সাতনরীহার, চম্পাকলি, মোহনমালা, হাতে তাগা, মাদুলি বাজার মান্তাশা, রত্নচূড়, আঙ্গুলে আঙ্গুষ্ঠার শাহনামী, অ্যানওয়ান, কোমরে বিছা, চন্দ্রহার কিন্ধিনী পায়ে, ঝাঝুরা পায়েল, তোড়া ইত্যাদি।
কাঁসা-পিতলজাত শিল্পঃ ঢাকার ধামরাই, সাভার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জামালপুরের ইসলামপুর, রংপুর, টাঙ্গাইল ও শরিয়তপুরে পারিবারিক শিল্প হিসেবে বংশ পরম্পরায় কাঁসা ও পিতলের বিভিন্ন দৈনন্দিন ব্যবহার সামগ্রী তৈরি হয়ে আসছে। কাঁসা-পিতলের কুটির শিল্প সংখ্যা প্রায় ৩৯০ এবং কারিগর প্রায় ২ হাজার। বাংলাদেশে প্রতি বছর ৩৩ কোটি ৩৭ লক্ষ টাকা মূল্যের কাঁসা-পিতল সামগ্রী তৈরি হয়।
নকশী কাঁথাঃ নকশি কাঁথা বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ সুচিকর্ম হলো নকশিকাঁথা। ১৩ ধরনের নকশি কাঁথা এদেশে তৈরি হয়। এগুলি হলো: চিত্রিত কাঁথা, মাটিকাঁথা ও পাইড় কাঁথা। বাংলাদেশের সর্বত্র কাঁথা প্রস্তুত হলেও রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রংপুর, ফরিদপুর ও কুষ্টিয়ার কাঁথা সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট মানের। এসকল অঞ্চলে লেপ কাঁথা, দুজনী কাঁথা, দুরনীকাঁথা, আরশীলতা, ওড়কাঁথা, বাতায়নকাঁথা ও দস্তরখানা প্রস্তুত হয়।